বিশেষ প্রতিনিধি:
এসআইদের অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গকেই একমাত্র কারণ হিসাবে কর্তৃপক্ষ দেখালেও সেখানে হিন্দুদের সংখ্যাটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় বলে মনে করছে বাংলাদেশ হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ বলেছেন,অভিযোগের তদন্ত স্পষ্ট হওয়া উচিৎ। এভাবে ঢালাও শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন,শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নিয়ম অনুযায়ীই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কারও ধর্মীয় পরিচয় দেখা হয়নি।
শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণে থাকা ২৫২ জন উপ-পরিদর্শককে (এসআই) চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় সম্প্রতি।
এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর আসে,তাদের মধ্যে ৯১ জন হিন্দু। এছাড়া রয়েছেন দুজন বৌদ্ধ এবং একজন খ্রিস্টান।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০২৩ সালে পুলিশের এসআই পদে নিয়োগের জন্য ৮২৩ জনকে চূড়ান্ত করে তাদের পাঠানো হয় সারদার পুলিশ একাডেমিতে। বিসিএসে যোগদানসহ বিভিন্ন কারণে ১৯ জন অব্যাহতি নেওয়ার পর সবশেষে ছিলেন ৮০৪ জন। ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে আগামী মাসেই তাদের চাকরিতে যোগদানের কথা ছিল।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসআই পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় এই নিয়োগ হয়েছে অভিযোগ করে তা বাতিলের দাবি জানায় দলটি। বিএনপি এই দাবি তোলার পাঁচ দিন পর গত সোমবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে ২৫২ জন এসআইকে একযোগে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এই ২৫২ জনের মধ্যে ৯১ জন হিন্দুর একাডেমির মন্দির দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক কর্মী। অব্যাহতি পাওয়াদের কাছ থেকে তাদের মধ্যে দুজন বৌদ্ধ ও একজন খ্রিস্টান থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। ৮০৪ জনের এই দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন ১৬৬ জন। তার মধ্যে একযোগে আরও দুজন হিন্দুকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মন্দিরের ঐ কর্মী বলেন,“একাডেমিতে প্রশিক্ষণরতদের জন্য প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় মন্দিরে সান্ধ্যপূজার আয়োজন করা হয়। সেই পূজায় অংশ নেওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ব্যাধ্যতামূলক। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকা আছে মন্দিরে।” সেই তালিকা ধরে তিনি বলেন,৪০তম ব্যাচে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৬৬ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে মোট ৯৩ জন এখন অনুপস্থিত। অব্যাহতি পাওয়াদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংখ্যাটি নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণরত এক এসআই বলেন,“২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার পর আরও ৫৯ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এদের মধ্যেও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে আছেন। আমিও তার একজন।”
এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “প্রশিক্ষণ থেকে কাউকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন মানা হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তাকে শোকজ করার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়। অনেকের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। এরপর যদি অপরাধ প্রমাণ হয়,তখন তাকে চূড়ান্ত অব্যহতি দেওয়া হয়।
“কিন্তু গত ২১ অক্টোবর যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এসব কিছুই হয়নি। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে শোকজ করার কয়েকদিনের মধ্যে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রেও একই পথে হাঁটা হচ্ছে।”
২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টিকে কারণ দেখানো হয়। এর বাইরে আরও ১০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে প্রশিক্ষণ ক্লাসে বসা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে।
অব্যাহতি পাওয়া এক এসআই বলেন, “একাডেমির নিয়ম হলো,কেউ কোনও অন্যায় করলে প্রথমে থাকে লঘুদণ্ড এবং একই অপরাধ বার বার করলে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়।
“কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সরাসরি অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে,তার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। নাশতা নিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের যে অভিযোগ করা হচ্ছে,সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখানো হোক। তাহলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।”
একসঙ্গে এতজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি ‘অস্বাভাবিক’ মন্তব্য করে হিন্দু বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা মনীন্দ্র নাথ বলেন,“বিষয়টি দুঃখজনক এবং একইসঙ্গে প্রশ্নবোধক। স্বাভাবিকভাবে হয়ত ২/৪ জন অব্যাহতি পেতে পারে,একসঙ্গে এতজনকে অব্যাহতি স্বাভাবিক হয় কীভাবে?
“এই ঘটনা একটি খারাপ সংকেত। ভবিষ্যতে এটি খারাপ কিছু বয়ে আনতে পারে। কারও বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ থাকে,তাহলে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে তদন্ত করা উচিৎ। এভাবে ঢালাও শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়।”
এর আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি সারদার একাডেমিই দেখে। সেখানে পুলিশ সদর দপ্তরের কোনও হাত নেই।
২৫২ জনের মধ্যে ৯১ জন হিন্দু থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ,অতিরিক্ত আইজিপি মাসুদুর রহমান ভুঞা বলেন,“আপনার কিছু জানার থাকলে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগাযোগ করুন।”
এরপর পুলিশ সদর সপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কারও ধর্মীয় পরিচয় দেখা হয়নি।
“সারদায় প্রশিক্ষণরত যে সকল ক্যাডেট এসআইদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে,তাদেরকে একেবারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ অর্থাৎ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।”
সব প্রক্রিয়া মেনেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে দাবি করে এআইজি ইনামুল বলেন, “যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক তাদেরকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।”
ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা পরিষদের সাবেক সভাপতি মণীন্দ্র নাথ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “সংখ্যালঘুদের বিষয়ে অতীতে বৈষম্য ছিল, এখনও সেই বৈষম্য রয়ে গেছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এত এত মানুষ জীবন দিল। অথচ এখনও বৈষম্য করা হচ্ছে।
“অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার কমিটি গঠন করা হলো। অথচ সেসব কমিটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তার মানে কী সংখ্যালঘুদের মধ্যে যোগ লোক নেই? এভাবে চলতে থাকলে তো আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে।”
সিলেট ২৪ বাংলা/এসডি.